গত অক্টোবর মাসে হায়দরাবাদে সেলুনে চুল কাটানোর সময় জাকির হোসেন টিভিতে দেখেন, সাত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাচ্ছে ভারত।
‘ওটা দেখেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার চিন্তাটাও আতঙ্কজনক,’ বলেন ২৫ বছর বয়সী হোসেন।
২০১৪ সালে তিনি পরিবারের লোকজন নিয়ে দুঃসাধ্য এক পথ পাড়ি দিয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে হায়দরাবাদে যান।
২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন অভিযান শুরু হওয়ার পর আক্রমণাত্মক বৌদ্ধ ও তাদের সহায়তা করা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
ভারতে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে বলে জানায় ভারত সরকার। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, এদের মধ্যে ১৮ হাজার প্রায় উদ্বাস্তু শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত। হোসেনও তাদের একজন। তিনি প্রথমে ঢুকেছিলেন বাংলাদেশে, যেখানে এখন প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। সেখান থেকে কয়েকদিন পর তিনি আরেকবার সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
‘বালাপুর শরণার্থী শিবিরের জীবন খারাপ না। রাখাইনে যা দেখেছি আর সহ্য করেছি, তারচেয়ে এই শহর অনেক ভালো জায়গা,’ বলেন হোসেন।
তবে হোসেন বেশিদিন এই নিরাপত্তা বোধ করতে পারেননি।
আলজাজিরাকে হোসেন বলেন, ‘গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে ভারতের পুলিশ নিয়মিত আমাদের ক্যাম্পে আনাগোনা শুরু করে। আমাদেরকে ফর্ম পূরণ করতে দেয় এবং বায়োমেট্রিক ডেটা দিতে বলে। ক্যাম্পে খবর ছড়িয়ে পড়ে আমাদের, মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।’
৪ অক্টোবর যখন সাত রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয় তখন সেখানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে প্রবেশ করার জন্য তারা ২০১২ সাল থেকে আসামের জেলে বন্দী ছিল।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোয় ভারতের তীব্র সমালোচনা করেছে। ‘রিফাউলমেন্ট’ বা শরণার্থীরা প্রাণ বাঁচাতে যেখান থেকে পালিয়ে আসেন সেখানেই তাদের ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত নিন্দনীয় বিবেচনা করা হয়।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘গণহত্যার উৎকৃষ্ট আদর্শ উদাহরণ’ তৈরি করেছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালিয়ে। সেনাবাহিনী সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের যথেচ্ছভাবে হত্যা, গণধর্ষণ করে এবং আগুন দেয়া হয় তাদের বাড়িঘরে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।
মিয়ানমারের সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
জাতিসংঘ জানিয়েছে বর্তমানে রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী।
হোসেন জানান, ভারতের পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আগেই তিনি মা ও ভাইসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেন।
বাংলাদেশে ফিরতে হোসেনের তিন মাস সময় লাগে। সীমান্তে বিএসএফ তাদের একদিন আটকে রাখার পর সীমান্ত পার হওয়ার অনুমতি দেয়।
বিজিবি তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিলে পুলিশ হোসেনের পরিবারকে কক্সবাজারের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়।
এ বছরের শুরু থেকে হোসেনের মতো আরো এক হাজার তিনশ রোহিঙ্গা শরণার্থী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
কাতারের সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরা জানায়, এই সপ্তাহে ভারতের পুলিশ কমপক্ষে ৬১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। মঙ্গলবার এদের মধ্যে ৩১ জন ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী ‘নোম্যানস ল্যান্ডে’ আটকা পড়লে তাদের আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়।
গত বছর ভারত সরকার সবগুলো রাজ্যকে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করে করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ‘সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোতে এদের যোগদানের সম্ভাবনা বেশি’।
উত্তর ভারতের জম্মু শহরের একটি ক্যাম্পের বাসিন্দা ফাইয়েজ আহমেদ (৭৫) গত ৭ জানুয়ারি ভারত ত্যাগ করেন। তিনি এখন কক্সবাজারের একটি ক্যাম্পে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের জন্য এখন নিরাপদ জায়গা মনে হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন ক্যাম্পে আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন রয়েছ। আমি ওখানে (জম্মুতে) শরণার্থী শিবিরে ছিলাম ছয় বছর। কিন্তু গত বছর পুলিশ ক্যাম্পে আসতে শুরু করায় সব বদলে যায়। ওরা আমদের ব্যক্তিগত তথ্য দিতে বলে।
তিনি আরো বলেন, সেখানে পরিস্থিতিও খুব সহিংস হয়ে উঠছিল। স্থানীয় হিন্দু নেতারা আমাদের হুমকি দিতে শুরু করে, ওরা বলে আমরা ভারত না ছাড়লে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।
আলজাজিরা জানায়, ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিতে একটা ভয়ের আবহ অনুভব করা যায়।
নতুন দিল্লিভিত্তিক মানবাধিকারকর্মী জাফর মাহমুদ বলেন, তার সংগঠন জাকাত ফাউন্ডেশন রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে চাইছে, কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য বাধা তৈরি করে যাচ্ছে।
আল জাজিরাকে মাহমুদ বলেন, ‘জাকাত ফাউন্ডেশন নিজেদের জমিতে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের জায়গা তৈরি করতে চাইছে, কিন্তু সরকার আমাদের বানাতে দিচ্ছে না।’
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডিরেক্টর মিনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি জঘন্য রকম অনুভূতিহীন।’
কিন্তু ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র নলিন কোহলি বলেন, ভারতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে না, কারণ নতুন দিল্লি এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নিরাপদ কিনা সেটা নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। মিয়ানমার সরকার বলেছে তারা এদের ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছুক।’
ভারত সরকারের পুনরাবৃত্তি করে কোহলি বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের ‘নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি’।
সুত্র : পরিবর্তন ডটকম