রাহবার২৪

দেহে ভাইরাস আছে, কিন্তু উপসর্গ নেই: নীরবে করোনা ছড়াচ্ছেন যারা

রাহবার২৪

রাহবার: যত দিন যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ততই নতুন নতুন সব তথ্য জানতে পারছেন। এর কিছু কিছু তাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

সবাই এতদিনে জেনে গেছেন যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হলে মানবদেহে জ্বর, কাশি, স্বাদ গন্ধের অনুভূতি চলে যাওয়া – এসব উপসর্গ দেখা দেয়।

কিন্তু এমন কিছু লোক আছেন যাদের দেহে কোনও উপসর্গই দেখা দেয় না। তারা জানতেও পারেন না যে তারা করোনাভাইরাস বহন করছেন – এবং সবচেয়ে ভয়ের কথা, তারা নীরবে অন্যদের সংক্রমিত করে চলেছেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঠিক কত মানুষের মধ্যে এরকম ‘উপসর্গ-বিহীন’ সংক্রমণ ঘটেছে, এবং এই ‘নীরব বিস্তারকারীরাই’ এই ভাইরাস এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী কিনা – তা জানা এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

সিঙ্গাপুরের সেই গির্জাটিতে কী ঘটেছিল?

জানুয়ারির ১৯ তারিখ সিঙ্গাপুরের দ্য লাইফ চার্চ এ্যান্ড মিশন নামের গির্জাটিতে রবিবার সকালের প্রার্থনায় যারা জড়ো হয়েছিলেন, তারা কেউ ভাবতেই পারেননি যে এখান থেকে করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে।

সেদিন সেই প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন এক প্রৌঢ় দম্পতি।

সেসময় চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা অনেকেই জানতেন কিন্তু সবারই ধারণা ছিল কোভিড-১৯ এ কেউ সংক্রমিত হলে তা বোঝা যাবে তার ঘনঘন কাশি দেখে।

ওই দম্পতির দু’জনেরই বয়স ৫৬ – দুজনের কারোরই কোনও কাশি ছিল না, অন্য কোনও উপসর্গ বা স্বাস্থ্য সমস্যাও ছিল না। ফলে গির্জার কারোরই তাদের নিয়ে অন্য কিছু ভাবার কোনও কারণ ছিল না।

সমস্যা হল, তারা সেদিন সকালেই সিঙ্গাপুর আসেন চীনের উহান শহর থেকে – যা তখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু।

প্রার্থনা শেষ হবার সাথে সাথেই তারা চার্চ থেকে চলে গিয়েছিলেন।

এর পর তিন দিন যেতে না যেতেই ঘটনা খারাপ দিকে মোড় নিতে শুরু করল। জানুয়ারির ২২ তারিখে প্রথমে সেই নারী অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর দু দিন পর অসুস্থ হলেন তার স্বামী।

পরে এক সপ্তাহের মধ্যে সিঙ্গাপুরের তিনজন স্থানীয় লোক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কোথা থেকে কীভাবে তারা সংক্রমিত হলেন – কেউ বুঝতে পারছিল না।

সিঙ্গাপুরে করেনাভাইরাস বিস্তারের সেখান থেকেই সূচনা।

রোগের উৎস সন্ধানকারী গোয়েন্দা

“আমরা একেবারেই বোকা বনে গিয়েছিলাম। যাদের দেহে রোগের কোনও লক্ষণ নেই , তারা কী করে অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে?” – বলছিলেন সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ভারনন লী।

কোভিড-১৯ সম্পর্কে তখন তাদের যেটুকু জানা ছিল – সেই জ্ঞান দিয়ে তারা বুঝতেই পারছিলেন না যে কী করে লোকের মধ্যে রোগটা ছড়াচ্ছে।

ড. লী তখন পুলিশ এবং রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা তদন্ত শুরু করলেন। কে কখন কবে কোথায় ছিলেন তার একটা মানচিত্র তৈরি করলেন।

এটাকেই বলে কনট্যাক্ট ট্রেসিং – যার মাধ্যমে কীভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছে তা জানা যায় এবং রোগ বিস্তার ঠেকানো যায়।

বলা হয় সিঙ্গাপুরের তদন্তকারীরা এ কাজে বিশেষ দক্ষ। কয়েকদিনের মধ্যে তার সেই গির্জার ১৯১ জন লোকের সাথে কথা বললেন, এবং বের করলেন যে তাদের মধ্যে ১৪২ জন সেই রোববারের প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন। এটাও বেরিয়ে এলো তার মধ্যে যে দু‌’জন সংক্রমিত হয়েছিলেন – তারা সেই চীনা দম্পতির সাথে একই প্রার্থনায় ছিলেন।

“হয়তো তারা কথা বলেছিলেন, বা পরস্পরকে সম্ভাষণ করেছিলেন – যা গির্জায় প্রার্থনার সময় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা‍” – বলছিলেন ড. লী।

এ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে কীভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। কিন্তু যে প্রশ্নের জবাব মিলছে না তা হলো: “সেই চীনা দম্পতির দেহে তো সংক্রমণের কোন লক্ষণ ছিল না। তাহলে তারা কিভাবে ভাইরাস ছড়ালেন ?”

তার ওপর আরো কঠিন একটি ধাঁধাঁরও কোন উত্তর পাওয়া গেল না। সেটা হচ্ছে , সিঙ্গাপুরের যে ৫২ বছর বয়স্ক মহিলা তৃতীয় সংক্রমিত ব্যক্তি ছিলেন – তিনি সেই প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু ওই গির্জাতেই সেদিন অন্য একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাহলে কীভাবে সংক্রমিত হলেন?

অপ্রত্যাশিত তথ্যপ্রমাণ মিলল সিসিটিভিতে

সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে তদন্তকারীরা গির্জার সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করতে শুরু করলেন।

তা থেকেই বেরিয়ে এলো এক অপ্রত্যাশিত তথ্য। চীনা দম্পতি গির্জা থেকে চলে যাবার পর তারা যে চেয়ারে বসেছিলেন, কয়েক ঘন্টা পর সেই চেয়ারেই এসে বসেছিলেন আক্রান্ত মহিলাটি।

বোঝা গেল, চীনা দম্পতিটির হয়তো নিজেদের কোন অসুস্থতা ছিল না বা কোন উপসর্গ ছিল না – কিন্তু তা সত্বেও তারা না জেনেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে অন্যদের সংক্রমিত করেছেন। হয়তো তাদের হাতে ভাইরাস লেগে ছিল, বা হয়তো তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে এটা ছড়িয়েছে। ঠিক কী ঘটেছে তা স্পষ্ট নয় – কিন্তু এর তাৎপর্য ছিল বিশাল।

এটা এমন এক তথ্য যা জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর আগে বলা হচ্ছিল করোনাভাইরাস ঠেকাতে হলে নিজের বা অন্যদের কোন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কিনা তার দিকে নজর রাখতে হবে।

কিন্তু এখন জানা গেল – কোন উপসর্গ না থাকলেও নীরবে এবং অদৃশ্যভাবে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। ড. লীর এই উপলব্ধির মুহূর্তটির কথা পরিষ্কার মনে আছে।

কিন্তু তাহলে এই ভাইরাসকে ঠেকানো যাবে কীভাবে?

উপসর্গ দেখা দেবার আগেই রোগ বিস্তার ঘটে যাচ্ছে

একে বলে প্রি-সিম্পটম্যাটিক ট্রান্সমিশন – যখন কারো দেহে কোভিড-১৯ সংক্রমণের লক্ষণ – যেমন জ্বর, কাশি – এগুলো দেখা দেবার আগেই অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়াতে শুরু করে।

এই জরিপে দেখা গেল, করোনাভাইরাস কারো শরীরে ঢোকার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত সময়টায় – কোন লক্ষণ দেখা না দিলেও – আক্রান্ত ব্যক্তি ‌অত্যন্ত সংক্রামক‌ বা হয়তো সবচাইতে বেশি সংক্রামক হতে পারেন ।

এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ – কারণ তাহলে আপনার দেহে উপসর্গ দেখা দেবার সাথে সাথে আপনার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আপনি সতর্ক করে দিতে পারেন যে তাদের এখন ঘরে আইসোলেশনে থাকতে হবে।

কিন্তু ঠিক কীভাবে একজন থেকে আরেকজনে ভাইরাস ছড়ায় – তা এখনো স্পষ্ট নয়।

সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি দেবার সময় নাক-মুখ দিয়ে যে ড্রপলেটস্ বা অতি ক্ষুদ্র পানির কণা বেরিয়ে আসে তার মধ্যেই থাকে ভাইরাস। কিন্তু যার কাশির উপসর্গ দেখা দেয়নি সে কীভাবে ভাইরাস ছড়াবে?

কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলছেন – কথা বলার সময় বা শ্বাস-প্রশ্বানের মাধ্যমেও ড্রপলেটস্ বেরিয়ে আসতে পারে। কারণ এ সময়টা শ্বাসনালীর ওপরের অংশেই ভাইরাসগুলো অবস্থান করে এবং প্রতিবার নি:শ্বাস ফেলার সময়ই এগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। কাজেই কাছাকাছি কেউ থাকলে – বিশেষত ঘরের ভেতরে – খুব সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।

সংক্রমণের আরেকটা বড় উপায় হলো স্পর্শ। কারো হাতে ভাইরাস লেগে থাকলে তিনি যদি আরেকজনের হাত ধরেন, বা দরজার হাতল, টেবিল-চেয়ার বা অন্য কিছু স্পর্শ করেন – তার মাধ্যমেও এটা ছড়াতে পারে।

কিছু লোক আছে যাদের কোন উপসর্গ দেখা যায় না

কিছু লোকের দেহে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে কিন্তু তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না – এই রহস্যময় ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে তার কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারছেন না।

এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ মেরি ম্যালন নামে গত শতাব্দীর এক আইরিশ মহিলা।

মেরি ম্যালন নিউ ইয়র্ক শহরের একাধিক বাড়িতে রাঁধুনী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি টাইফয়েডের জীবাণু বহন করছিলেন, কিন্তু তার নিজের দেহে কোন লক্ষণ ছিল না।

ফলে এই মেরি ম্যালন নিউইয়র্কের বাড়িতে বাড়িতে টাইফয়েড সংক্রমণ ছড়াচ্ছিলেন – যাতে তিন জন লোকের মৃত্যু হয়েছিল।

ব্যাপারটা নিশ্চিত হবার পর নিউইয়র্কের কর্তৃপক্ষ ১৯৩৮ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ২৩ বছর আটক করে রেখেছিল।

ব্রিটেনের কেম্ব্রিজের এ্যাডেনব্রুক হাসপাতালের একজন নার্স এ্যামেলিয়া পাওয়েল এমনই একজন – যিনি এ্যাসিম্পটম্যাটিক, অর্থাৎ তার দেহে ভাইরাস উপস্থিত থাকলেও এর কোন লক্ষণ ছিল না।

তিনি বলছিলেন, “আমি হাসপাতালের রোগীদের দেখে চিন্তিত হতাম যে কোন দিন আমারও এটা হতে পারে কিনা। কিন্তু আমি নিজে কোন কিছুই অনুভব করিনি, আমি স্বাভাকিভাবেই খাওয়াদাওয়া, ঘুম, ব্যায়াম করছিলাম। “

একেবারেই ঘটনাচক্রে হাসপাতালের স্টাফদের এক জরিপে অংশ নেবার কারণে তার করোনাভাইরাস টেস্ট করাতে হয়। পরীক্ষায় করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ার পর তাকে কাজ ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে হয়।

ওই জরিপে ধরা পড়ে যে প্রতি এক হাজার লোকের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ লোকের দেহে করোনাভাইরাস থাকলেও তার কোন উপসর্গ দেখা যায় না।

ডায়মন্ড প্রিন্সেস নামে যে প্রমোদতরীটি ভাইরাস সংক্রমণের কারণে জাপান উপকূলে আটকে রাখা হয়েছিল – তার ৭০০ যাত্রীর মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই ছিলেন এ্যাসিম্পটম্যাটিক।

এরকম লোকের সংখ্যা কত?

করোনাভাইরাস সংক্রমণ সংক্রান্ত ২১টি গবেষণা প্রকল্পের উপাত্ত পরীক্ষা করে দেখেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্ল হেনেগ্যান।

তিনি বলছেন, উপসর্গবিহীন কোভিড-১৯ ভাইরাস বহনকারীর অনুপাত ৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর সংখ্যা নির্ণয় করার মতো নির্ভরযোগ্য জরিপ একটিও নেই।

এরকম লোকেরা কত বড় ঝুঁকি?

এ্যামেলিয়ার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, তিনি হয়তো না জেনেই তার সহকর্মী বা তার পরিচর্যা পাওয়া রোগীদের কোভিড-১৯ ভাইরাসে সংক্রমিত করেছেন।

তিনি কতদিন ধরে কোভিড পজিটিভ তাও তিনি জানেন না। তবে তার কথা , “আমরা এটাও জানিনা যে উপসর্গবিহীন লোকেরা আসলেই সংক্রামক কি না, এটা সত্যি বড়ই অদ্ভুত।“

চীনের একটি জরিপে দেখা গেছে, উপসর্গবিহীনদের সংখ্যা আসলে উপসর্গ দেখা গেছে এমন কোভিড রোগীদের চেয়ে বেশি, এবং এটা সংক্রমণ রোধ বা নিয়ন্ত্রণের কর্তৃপক্ষের মনোযোগ দাবি করে।

ব্রিটেনের আর্লহ্যাম ইনস্টিটিউট নামে একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান অধ্যাপক নিল হলের মতে, উপসর্গবিহীন কোভড বহনকারীরা হচ্ছেন এই মহামারির ‘ডার্ক ম্যাটার।‘

হয়তো তারাই এ মহামারি জিইয়ে রেখেছে, বলছেন তিনি। ক্যালিফোর্নিয়ার একদল বিজ্ঞানী বলছেন, মহামারির ব্যবস্থাপনার ওপর এ ধরণের উপসর্গবিহীন সংক্রমণের ঝুঁকি এক গভীর প্রভাব ফেলছে।

এখন, যখন বিভিন্ন দেশে একে একে লকডাউনজনিত বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে, তখন এই অদৃশ্য ঝুঁকির মোকাবিলা করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

সরকারগুলো বলছে, এজন্য সম্ভব সকল ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা এবং তা না পারলেও মাস্ক ব্যবহার করা – এগুলোই হতে পারে সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা।

হয়তো এগুলোতে ভাইরাস বিস্তার পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হবে না। কিন্তু আমরা এ সম্পর্কে এখনো এত কম জানি যে – এই পন্থাগুলো চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কী? সূত্র: বিবিসি বাংলা

Follow us

get in touch. stay updated.

জনপ্রিয়