রাহবার২৪

ধর্ষকের লাশ দাফন করতে দিল না তুরস্কের জনগণ!

অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে কোমরে গুঁজে রাখা ছুরিটা বের করে সেটা দিয়ে আসলানকে একের পর এক আঘাত করতে থাকে সুফী। রক্তাক্ত অবস্থায় আহত মেয়েটা যখন বাসের মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছিল, তখন একটা লোহার রড দিয়ে বারবার তাকে আঘাত করে গেছে এই অমানুষটা, যতোক্ষণ না আসলানের দেহটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ


তুরস্কের একটা ঘটনা বলি আজ। ২০১৫ সালের কথা, ওজগেকান আসলান নামের উনিশ বছর বয়েসী এই তরুণী ছিল সাইকোলজির ছাত্রী। মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগতো তার। নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে তার বেড়ে ওঠা, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপটা না পেলে হয়তো পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে পারতো না সে। তার পড়ালেখার খরচ জোগানোর জন্যে তার মা একটা হোটেলে বাড়তি কাজ করা শুরু করেছিলেন। চাকুরী করে বাবা-মায়ের রক্ত পানি করা পরিশ্রমটাকে সার্থক করবে, এমনটাই হয়তো ভাবনা ছিল আসলানের। কিন্ত মানুষ ভাবে কে, হয় আরেক। মানুষের মনের হিজিবিজি রেখা নিয়ে ভাবতে থাকা সেই মেয়েটা হয়তো জানতো না, বিকৃতমনস্ক কয়েকজন পুরুষের লালসার শিকার হয়ে মাত্র উনিশ বছর বয়সেই তাকে পাড়ি জমাতে হবে না ফেরার দেশে!

২০১৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী ক্লাস শেষে এক বান্ধবীর সঙ্গে শপিংমলে গিয়েছিল আসলান। সেখান থেকে খেয়েদেয়ে বেরুতে বেরুতে রাত হয়ে এসেছিল প্রায়। বাড়ি ফেরার জন্যে মিনিবাসে উঠেছিল দুই বান্ধবী। আসলানের সেই বান্ধবী তার বাড়ির সামনে নেমে গিয়েছিল, আসলানের গন্তব্য আরও খানিকটা দূরে। গাড়িতে তখন সে একাই যাত্রী ছিল। কিন্ত সেই রাতে আসলান আর ঘরে ফেরেনি।

পরদিন আসলানের পরিবারের সদস্যেরা থানায় রিপোর্ট করে। যোগাযোগ করা হয় আসলানের সেই বান্ধবীর সঙ্গে। তার দেয়া তথ্যমতে পুলিশ খুঁজতে থাকে সেই মিনিবাস আর তার চালককে। কিন্ত গাড়ির নাম্বার মনে ছিল না আসলানের বান্ধবীর। সেদিন রাতে সেই পথ দিয়ে যেসব যানবাহন গিয়েছে, সবাইকেই একটা চেকপোস্ট পার হয়ে যেতে হয়েছিল। সেই চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের সাহায্য নেয় পুলিশ। সেখান থেকে পাওয়া গেল অদ্ভুত একটা তথ্য, সেদিন রাতে একটা খালি মিনিবাস আটক করেছিল চেকপোস্টের নিরাপত্তাকর্মীরা, বাসের মেঝেতে রক্তের ফোঁটা দেখে সন্দেহ হয়েছিল তাদের। তবে ড্রাইভার জানিয়েছিল, বাসের দু’জন যাত্রী মারামারি করাতেই নাকি এই রক্ত মেঝেতে পড়েছে। সন্দেহজনক আর কিছু না পেয়ে গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছিল তারা।

নম্বর মিলিয়ে পুলিশ এবার খুঁজে বের করলো সেই মিনিবাসটাকে। আসলানের বান্ধবী সনাক্ত করলো মিনিবাসের চালক সুফীকে। পুলিশ কাস্টোডিতে নেয়া হলো তাকে। কিছুক্ষণ ভুলভাল তথ্য দেয়ার পরে হঠাৎ করেই লোকটা স্বীকার করলো, আসলানকে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে খুন করেছে সে। আর মৃতদেহ গুম করতে তাকে সাহায্য করেছে তার বাবা আর এক বন্ধু!

পুরো ঘটনাটাই তার জবানবন্দীতে রেকর্ড করা হয়। সেদিন রাতে আসলানের বান্ধবীকে নামিয়ে দেয়ার পরে একা মেয়েটাকে পেয়েই ধর্ষণের পরিকল্পনা করে সুফি। মূল সড়ক ছেড়ে জঙ্গলের দিকে গাড়ি ঘোরায় সে। নির্জন একটা জায়গায় নিয়ে গাড়ি থামিয়ে আসলানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। আসলান সম্ভবত এরকম কিছুর জন্যে প্রস্তত ছিল, ব্যাগে থাকা পিপার স্প্রে’টা বের করে রেখেছিল সে। সুফী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই সেটা লোকটার মুখের ওপর সরাসরি স্প্রে করেছিল আসলান। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে কোমরে গুঁজে রাখা ছুরিটা বের করে সেটা দিয়ে আসলানকে একের পর এক আঘাত করতে থাকে সুফী। রক্তাক্ত অবস্থায় আহত মেয়েটা যখন বাসের মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছিল, তখন একটা লোহার রড দিয়ে বারবার তাকে আঘাত করে গেছে এই অমানুষটা, যতোক্ষণ না আসলানের দেহটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

মৃত্যু নিশ্চিত হবার পরে আসলানের দেহটা সেই জঙ্গলের মধ্যেই লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল খুনি সুফী। তারপর বাড়ি ফিরে তার বাবা আর এক বন্ধুকে পুরো ঘটনা খুলে বলে। তিনজন মিলে আবার জঙ্গলের সেই জায়গাটায় ফিরে আসে, যেখানে আসলানের লাশটা রেখে গিয়েছিল সুফী। ওরা তিনজন আসলানের মৃতদেহটা পুড়িয়ে ফেলে, যাতে এটাকে সনাক্ত করা না যায়। পোড়ানোর আগে আসলানের দুই হাত কেটে নিয়েছিল ওরা, যাতে পুলিশ লাশটা খুঁজে পেলেও মৃতদেহ থেকে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির ডিএনএ স্যাম্পল বের করতে না পারে। মৃত্যুর আগে সুফীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছিল আসলানের, তার হাতে বা নখের ফাঁকে কোন আলামত লেগে থাকলে সেটা পুলিশের ফরেনসিক টিম বের করে ফেলতে পারতো খুব সহজেই। এজন্যেই মৃতদেহ থেকে হাত দুটো আলাদা করে অন্য এক জায়গায় পুঁতে ফেলেছিল ওরা। আর বাকী দেহটা ফেলে দিয়েছিল জঙ্গলের ভেতরের একটা খাঁড়িতে।

মৃত্যুর একদিন পরে, তেরোই ফেব্রুয়ারী খুনী সুফীর দেয়া তথ্যমতে সেই পরিত্যক্ত খাঁড়ি থেকে আসলানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। নিজের জীবন দিয়ে ধর্ষণ ঠেকিয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নারীদের তীব্র আন্দোলন। প্রতিক্রিয়াশীল এই দেশটিতে নারীরা যে খুব সম্মানজনক অবস্থানে আছেন, এমনতা নয়। সেখানেও নারী নিগ্রহ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটে। কিন্ত আসলানের ঘটনাটা সবার মনে দাগ কেটে গিয়েছিল প্রবলবভাবে। মেডিকেলের মর্গ থেকে আসলানের লাশ মিছিল করে নিয়ে এসেছিল নারীরাই, শেষবারের মতো তাকে গোসল করিয়ে জানাজা পড়িয়েছিল নারীরা। আসলানের কফিন কাঁধে করে তাকে কবরস্থানে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের প্রায় সবাই নারী। সেই নারীরাই দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন, কোন পুরুষকে আসলানের মৃতদেহটা ছুঁতেও দেননি!

আদালতে তোলা হলো তিন অপরাধীকে। ইতিমধ্যে কয়েকবার বয়ান পাল্টানোর চেষ্টা করেছে তারা, একেক সময় একেক রকম মনগড়া গল্প ফেঁদেছে। পুরো প্রদেশের একজন উকিলও তাদের পক্ষে দাঁড়াননি, যিনি ওদের হয়ে মামলা লড়েছিলেন তিনিও এই অপরাধীদের আত্নীয় বলেই মামলাটা নিয়েছিলেন। তুরস্কে মৃত্যুদণ্ডের প্রথা নেই, সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্ত এই অমানুষগুলোকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার জন্যে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন নারীরা, সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ দিয়ে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন মানুষ। তাতে অবশ্য আইন পুরোপুরি বদলায়নি, তবে ধর্ষণ বা খুনের আসামীরা ভালো ব্যবহারের জন্যে সাজা মওকুফের তালিকা থেকে বাদ থাকবেন, এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। শেষমেশ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাই পেয়েছিল তিন অপরাধী।

তবে স্রষ্টা মানুষের অপরাধের বিচারের খানিকটা দুনিয়াতেই করে ফেলেন কখনও কখনও। জেলখানায় সুফী, তার বাবা আর বন্ধু ফাতিহকে সারাক্ষণই থাকতে হতো প্রচণ্ড রকমের একটা ভয়ের মধ্যে। সাধারণ কয়েদীরা দুই চোখে দেখতে পারতো না ওদের তিনজনকে। মাঝেমধ্যেই কয়েকজন মিলে চড়াও হতো ওদের ওপর। ২০১৬ সালের ১১ই এপ্রিলে গুলতেকিন আলান নামের পঞ্চাশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদি বন্দুক নিয়ে গুলি করেন সুফী আর তার বাবাকে। দুজনকেই হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানে মৃত্যু হয় সুফীর। তার বাবা সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান। নিহত সুফীর লাশটা পাঁচদিন ধরে পড়েছিল হাসপাতালের মর্গে, দাফন করা যাচ্ছিল না, কারণ মারসিন প্রদেশ, যেখানে সুফী আর আসলান দুজনের বাড়ি, সেখানকার লোকজন কোনভাবেই এই খুনীর লাশ এই এলাকায় দাফন করতে দিতে রাজী ছিল না। সুফীর মায়ের শত অনুরোধের পরেও মন গলেনি কারো, সবার এক কথা- এই পাপিষ্ঠের মৃতদেহ এই এলাকার মাটিতে ঠাঁই পেতে পারে না। মৃত্যুর পাঁচদিন পরে এক মধ্যরাতে পুলিশি প্রহরায় অন্য এক এলাকায় নিয়ে একটা অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হয় সুফীর লাশ।

বাংলাদেশে পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। চারপাশটা কেমন যেন অসুস্থ লাগে। দেড় বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা, হায়েনাদের করাল গ্রাস থেকে বাদ থাকছে না কেউ। যে পর্দার কথা বলে একটা শ্রেণীর মানুষ মুখে ফেনা তুলে ফেলে, সেই বোরখা পরে বেরুনোর পরেও গণধর্ষণ করে খুন করা হয় তরুণীকে! অথচ ধর্ষণের বিচার হয় না এখানে। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতায় আশকারা পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষকেরা। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই উৎসাহী করে তুলছে তাদের।

কাল আপনি দশজন ধর্ষকের বিচার করুন, এক হাজার ধর্ষক তাদের ধর্ষকামী চিন্তাভাবনাগুলো আরেকবার প্রকাশের আগে একশোবার ভাববে। কিন্ত বিচারটাই তো হচ্ছে না। তুরস্ক কিংবা ভারতের সামাজিক অবস্থান আমাদের তুলনায় আহামরি ভিন্ন কিছু নয়। অথচ ওরা ধর্ষককে বয়কট করতে পারছে, ধর্ষকের বিচার করে সাজা দিতে পারছে, কিন্ত এই একটা জায়গায় আমরা যোজন যোজন পিছিয়ে আছি বাকীদের চেয়ে। আর এজন্যেই ধর্ষণ থামছে না, থামছে না এইসব নরপশুদের আস্ফালনও।

Follow us

get in touch. stay updated.

জনপ্রিয়