রাহবার২৪

এরদোগান এবং তুর্কী নারী লায়লা : গল্পকে হার মানায় যে গল্প

রাহবার২৪

রাকিবুল হাসান: রাতের খাবার খেয়ে মাত্রই শুয়েছেন তুরস্কের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. ফাহরুদ্দিন খোজার। শরীর আজ ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে যেন। খাবার না খেয়েই শুয়ে যেতে চাইছিলেন। স্ত্রীর অনুরোধে খেতে হলো। খেয়েই সটান শুয়ে পড়েছেন ঝড়ে ভেঙে পড়া ডুমুর গাছের মতো। তবুও কী মনে করে যেন এই ক্লান্ত চোখেও ওপেন করলেন টুইটার। স্ক্রল করতে করতে একটি টুইটে তার চোখ থমকে গেলো। বড় করে তাকালেন তিনি। মাত্র ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও তার সব ক্লান্তিকে ঝাপটে ধরলো। তিনি হাঁসফাঁস শুরু করলেন।

ভিডিওতে যে কিশোরি মেয়েটি কথা বলছে, তার নাম লায়লা। তুরস্কের নাগরিক। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে থাকে সুইডেনে। ডা. ফাহরুদ্দিন ভিডিওটি অন করলেন। সুদর্শনা লায়লা তুরস্কের কাছে মিনতি জানিয়ে বলছে, ‘আমি আজকে আমার প্রিয় নেতা, তুরস্কের গর্ব এরদোগানের কাছে কিছু চাইব। নিজের জন্য না, আমার বাবার জন্য। তুরস্কের বাতাসে বেড়ে ওঠা এক নাগরিকের জন্য।

আমার বাবা ইকরামুল্লাহ গুলসকেন। ১১ দিন আগে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সন্দেহ হলে চিকিৎসককে খবর দেই। বাড়িতে একজন চিকিৎসক আসেন। বাবাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে নেয়ার পর বাবার শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। কিন্তু ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি না করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এখন আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে আছি। চিকিৎসা পাচ্ছি না। এই সময় আমি আমার দেশকে পাশে চাই।’

ভিডিওটি শেয়ার করে লায়লার বোন সামিরা লিখেন—’আমরা আমার পরিবারের সাথে সুইডেনে থাকি। আমার বাবার ১১ দিন আগে জ্বর হয়। সাথে শ্বাসকষ্ট। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তার ডাকলাম। কিন্তু তারা আমাদের যাকে সাড়া দিলো না। পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন অনেকবার ফোন করেছি। কিন্তু তারা আসেনি। আমরা আমাদের দেশ তুরস্কের কাছে সাহায্য চাই। আশা করি আমার দেশ আমার পাশে দাড়াবে।’

ডা. ফাহরুদ্দিন খোজারের ইচ্ছে করছে এখনই উড়ে গিয়ে ইকরামুল্লাহকে নিয়ে আসেন। তুরস্ক অন্য দেশকে সাহায্য করছে এই সঙ্কটকালে, আর তার নাগরিক অন্যদেশে চিকিৎসা পাবে না? তার বুকটা খানিক চিনচিন করে উঠলো। তিনি কল করলেন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের নম্বরে। ফোনটা তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই সময়ে ফোন?’ ডা. খোজার বিস্তারিত সব জানালেন। এরদোগান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, ‘প্রাইভেট বিমানে তাকে নিয়ে আসো। আমার দেশের নাগরিক আমাদের দেশে চিকিৎসা দেবো।’

এবার সত্যিই উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে ডা. ফাহরুদ্দিন খোজারের। উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি তার ভেরিফায়েড আইডি থেকে লিখেন—’প্রিয় লায়লা, আমরা তোমাকে শুনতে পেয়েছি। বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমরা সুইডেনে আসছি। সকাল ৬টায় আমরা রওয়ানা দিচ্ছি। এমন সময় আমি দূরে থাকার জন্য দুঃখিত। তুরস্কের হাসপাতাল ও চিকিৎসক তোমার বাবার চিকিৎসা করতে প্রস্তুত। আমাদের প্রেসিডেন্টের শুভেচ্ছা নিও। তুরস্কের সব মানুষের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অনেক ভালোবাসা।’

সকালেই সুইডেনের মালমো বিমান বন্দরে পৌঁছে তুরস্কের জিএমটি ০৭০০ বিমান। সুইডেন থেকে করোনায় আক্রান্ত ৪৭ বছর বয়সী ইমরুল্লাহ গলুসকেন এবং তার তিন কন্যাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পরে শুরু হয় চিকিৎসা তৎপরতা। রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর ইমরুল্লাহ গলুসকেন এবং তার তিন কন্যাকে আঙ্কারার ইহির হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া পড়ে যায়। প্রশংসার জোয়ারে ভাসতে থাকে তুরস্ক। সমালোচনার বাণে বিদ্ধ হতে থাকে সুইডেন।

দেশে ফেরার পর লায়লার সাথে ফোনে কথা বলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। লায়লার বাবাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরে তিনিও দারুণ আনন্দিত। তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। এই দেশের জনগণ তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তিনি তার ঋণ শোধ করতে চান। তুরস্ককে আলাদা মহিমায় ভাস্বর করে তুলতে চান।

এরদোগান সান্ত্বনা দিয়ে লায়লাকে বললেন, ‘আপনার বাবা তুরস্কে পৌঁছেছেন। আমি আশা করি আমাদের সহকর্মীরা তাকে সুস্থ করে তুলবেন। আল্লাহ তাকে নিরাময় দেবেন। আপনি চিন্তা করবেন না।’

জবাবে লায়লা বললো, ‘আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপনার সাথে কথা বলতে পেরে খুশি। আমি আমাদের দেশ এবং আপনাকে নিয়ে গর্বিত। আমার বাবাকে দেশে নিয়ে আসায় কৃতজ্ঞ। যারা এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাদের ধন্যবাদ। আমরা বেঁচে আছি বলে আনন্দিত।’

লায়লার সঙ্গে কথা বলেই ২৬ এপ্রিল টুইট করলেন এরদোগান—’আজ আমি আমার বোন লায়লার সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছি। লায়লা ইমরুল্লাহর মেয়ে। তাকে আমরা সুইডেন থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে নিয়ে এসেছি।’

আঙ্কারার ইহির হাসপাতালে জানালার পাশে বসে আকাশ দেখছে লায়লা। তার মনে হচ্ছে এই আকাশ, এই দেশ তার কত আপন, কত জনমের আত্মীয়। চোখ বন্ধ যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা যায়। নিজের দুঃখগুলো বলা যায়। সে তো দেশকে কিছু দিতে পারেনি। কিন্তু দেশ আজ তাকে আঁচল ভরে দিয়েছে। টুইটার স্ক্রলে তার চোখে পড়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে লেখা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. খোজার টুইট। তাকে সান্ত্বনা জানিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রীর লেখা ফহরুদ্দিন আলতুনের টুইট। সাধারণ একটা মেয়েকে তারা অসাধারণ ভালোবাসা দিয়েছে তারা। এমন আপন মানুষ, এমন আপন দেশ ছেড়ে সুইডেনে যেতে তার ইচ্ছে করছে না।

কিশোরি লায়লা তার নরোম আঙুলেের কোমল স্পর্শে টুইটারে লিখলো—‘আমি জানতাম আমার দেশ আমাকে সমর্থন করবে। এই কঠিন সময়ে দেশ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহরুদ্দিন খোজাকে ধন্যবাদ জানাই। তুরস্কের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বিত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন আমার টুইটের জবাব দিয়েছেন, এর পর থেকে তুর্কি কর্মকর্তারা আমার সাথে অনবরত যোগাযোগ করে গেছেন। আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন।’

-ফাতেহ২৪ এর সৌজন্যে

Follow us

get in touch. stay updated.

জনপ্রিয়